‘গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহি ‘বটবৃক্ষ’!’

‘গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহি ‘বটবৃক্ষ’!’

‘কথায় বলে বটবৃক্ষের যেমন ছায়া, তেমনি রয়েছে এই বৃক্ষের প্রতি মানুষের অফুরন্ত মায়া!’ তাই আজও মনে করিয়ে দেয় গ্রামীণ ঐতিহ্য সেই বটবৃক্ষের কথা। একটা সময় ছিল যখন গারো পাহাড়াঞ্চলজুড়ে, বাড়ির সামনে, জমির ধাওে, রস্তার পাশে ও বিভিন্ন জায়গায় প্রায়ই বটগাছ দেখা যেত। অনেক ক্ষেত্রে ঠিকানা নির্ধারণের জন্যও সেই স্থানকে ‘বটতলা’ বলে অভিহিত করা হতো। সে রকমই একটি স্থান ঝিনাইগাতী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গজনী ‘বটতলা’। যার পুরাতন সেই স্মৃতি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করেই সেই বটতলায় বনভোজন চলে আসছিল বহুকাল থেকেই। আর সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেই সেখানে শেরপুর জেলা প্রশাসন গড়ে তোলেছেন সেই বটতলায় ‘ঐতিহ্যবাহী গজনী অবকাশ পর্যটন কেন্দ্র।’ যা শেরপুর জেলা ও ঝিনাইগাতী উপজেলাকে করেছে সারা দেশে সুপরিচিত। অর্থাৎ অবকাশ পর্যটন কেন্দ্র মানেই শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলা। তবে বর্তমানে গ্রামীণ জনপথ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এসব ঐহিত্যবাহী বটবৃক্ষ। এক সময় গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চলজুড়ে গ্রাম বাংলায় পথের ধারে, নদীর পাড়ে, হাট-বাজারে অথবা জনবিরল স্থানে ডাল-পাতায় ভরা বটগাছ ছিল পথিকদের বিশ্রামের সর্বউত্তম স্থান। যা ছিল মানুষ, পশু-পাখি ও কীটপতঙ্গের অকৃত্রিম বন্ধু। গ্রাম-গঞ্জে মেলা ও বসত কোন কোন বটবৃক্ষের নিচে। হিন্দু সম্প্রদায় ও পুঁজা পার্বন করতেন সেসব বটবৃক্ষের নীচে। অনেক বটবৃক্ষের নিচে থাকতো মন্দির! কিন্তু সময়ের বিবর্তণে বটগাছের সেই ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। মনে হয় আর কিছুদিন পর গারো পাহাড়ের সেই ঐতিহ্যবাহী বটবৃক্ষ হয়ে যাবে কল্পকাহিনী! তবে গ্রামীণ জনপদে এখনো কোথাও কোথাও হঠাৎ দুই একটি কয়েক শতবর্ষী বটগাছ টিকে আছে। যা নিয়েও রয়েছে কত শত কল্পকাহিনী। বর্তমানে প্রাচীন আমলের দুই-একটি বটগাছ চোখে পড়লেও অনেকাংশে মানুষের চলাফেরার সুবিধার্থে এগুলো কেটে ফেলা ও হচ্ছে। বটগাছের ফল কোনো কাজে না আসলেও এর ঠান্ডা ছায়া অতি লোভনীয়। ক্লান্তি দূর করতে বটগাছের ছায়া গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। জীবন-জীবিকার তাগিদে ছুটতে গিয়ে অনেক সময় মানুষ ভুলে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য। প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণ করার দায়িত্বে থাকা উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, একটি বটগাছ কাটার সঙ্গে সঙ্গে ৩ শতাধিক প্রজাতির আবাস নষ্ট হয়। তাই মানুষের প্রয়োজনেই পরিবেশবান্ধব বটগাছ সংরক্ষণ ও রোপণ করা দরকার। বট গাছের ফল কাক, শালিক ও বাঁদুড়ের প্রিয় খাদ্য। বটগাছ বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম। ভ‚মি ক্ষয় রোধে বটগাছের জুড়ি নেই। সালোক সংশ্লেষণের সময় অন্য গাছের চেয়ে বাতাস থেকে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয় এই বটবৃক্ষ। গাছের শিকড় অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশের মাটি আঁকড়ে রাখে। ঝিনাইগাতীর শতবর্ষী ডা. আব্দুল বারী জবাবদিহিকে বলেন, বটগাছ বাংলা সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সংস্পর্শে মিশে আছে। আজ থেকে প্রায় ২০-২৫ বছর আগেও গ্রামীণ জনপথে চোখে পড়তো বটবৃক্ষসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গাছ রোপণ করা হলেও বটগাছ রোপণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছেনা। বটের পাতা একান্তর, ডিম্বাকৃতি, মসৃণ ও উজ্জল সবুজ। কঁচি পাতা তামাটে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে পাতার আয়তনের বিভিন্নতা একাধারে বটের বৈশিষ্ট্য তথা প্রজাতি শনাক্তকরণের পক্ষে জটিলতার কারণও। পরিণত গাছের পাতা আকারে কিছুটা ছোট হয়ে আসে। বটগাছ (Banyan) Moraceae গোত্রের। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ficus benghalensis. বৃহদাকার এই গাছ অনেক জায়গা জুড়ে জমির সমান্তরাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে। খুব অল্প বয়স থেকেই বটগাছের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা থেকে ঝুরি নামতে শুরু করে। মাটির সমান্তরালে বাড়তে থাকা ডালপালার ঝুরিগুলো একসময় মাটিতে গেঁথে গিয়ে নিজেরাই একেকটা কান্ডে পরিণত হয়। পাখিরা ফল খেয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয়। পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিশ, পুরনো দালানের ফাটল ও অন্য কোনো গাছের কোটরে সহজেই অঙ্কুরিত হয় এবং আশ্রয়কে গ্রাস করে। উপযুক্ত পরিবেশে একটি বটগাছ ৫ থেকে ৬শ’ বছর বেঁচে থাকে। বট বাংলাদেশের আদিমতম বৃক্ষ। এই গাছকে ভারতে পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই গাছের নিচে মন্দিরও বানায়। পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিশ, পুরনো দালানের ফাটল ও অন্য কোনো গাছের কোটরে সহজেই অঙ্কুরিত হয় এবং আশ্রয়কে গ্রাস করে। উপযুক্ত পরিবেশে একটি বটগাছ ৫ থেকে ৬শ’ বছর বেঁচে থাকতে পারে। বটের নানা রকম উপকারিতা ও রয়েছে। এর কষ থেকে নিম্ন মানের রাবার তৈরি হয়। বাকলের আঁশ দড়ি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার্য। এর পাতা কুষ্ঠরোগে উপকারী। বটের আঠা পা ফাটা সারায়। বটের ছাল দেহের মেদ কমায়। এ ছাড়া হাড় মচকে গেলে এর ছাল বেটে গরম করে মালিশ করলে আরাম পাওয়া যায়। উপকারিতা ও ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে বটগাছ ভারতের জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে ধর্মীয় কারণে বটগাছ কাটা নিষিদ্ধ।

‘ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, হারিয়ে যাওয়া বটগাছ তো আমরা অন্তত. চিনি। কিন্তু ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তোবা এক সময় চেনতেই পারবে না। এই মূল্যবান গাছ সংরক্ষণ করা অপরিহার্য্য। বটগাছ খুবই উপকারি গাছ। বটগাছের মতো উদার মন থাকলেই কেবল আমরা এই গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব। প্রাচীণকাল থেকেই এই গাছ দেখা গেছে বলে গুরুজনদের কাছে জানা বা শোনা যায়। তাই এখনো যাই কিছু বটবৃক্ষ রয়েছে তা সংরক্ষনে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।’